জীবন—সঙ্গীত (হেমন্তচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - বাংলা সাহিত্য কবিতা | - | NCTB BOOK
1.6k
1.6k

বলো না কাতর স্বরে                    বৃথা জন্ম এ সংসারে

                       এ জীবন নিশার স্বপন,

দারা পুত্র পরিবার                        তুমি কার কে তোমার

                     বলে জীব করো না ক্ৰন্দন;

মানব-জনম সার,                        এমন পাবে না আর

                     বাহ্যদৃশ্যে ভুলো না রে মন;

কর যত্ন হবে জয়,                        জীবাত্মা অনিত্য নয়

                     ওহে জীব কর আকিঞ্চন ।

করো না সুখের আশ,                    পরো না দুখের ফাঁস

                      জীবনের উদ্দেশ্য তা নয়,

সংসারে সংসারী সাজ,                    করো নিত্য নিজ কাজ,

                      ভবের উন্নতি যাতে হয় ।

দিন যায় ক্ষণ যায়,                          সময় কাহারো নয়,

                      বেগে ধায় নাহি রহে স্থির,

সহায় সম্পদ বল,                            সকলি ঘুচায় কাল,

                       আয়ু যেন শৈবালের নীর ।

সংসার-সমরাঙ্গনে                           যুদ্ধ কর দৃঢ়পণে,

                        ভয়ে ভীত হইও না মানব;

কর যুদ্ধ বীর্যবান,                            যায় যাবে যাক প্ৰাণ

                          মহিমাই জগতে দুর্লভ।

মনোহর মূর্তি হেরে,                          ওহে জীব অন্ধকারে,

                          ভবিষ্যতে করো না নির্ভর

অতীত সুখের দিনে,                         পুনঃ আর ডেকে এনে,

                            চিন্তা করে হইও না কাতর ।

মহাজ্ঞানী মহাজন,                          যে পথে করে গমন,
                          হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়,

সেই পথ লক্ষ্য করে                         স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে

                          আমরাও হব বরণীয়

সমর-সাগর-তীরে,                         পদাঙ্ক অঙ্কিত করে

                         আমরাও হব হে অমর;

সেই চিহ্ন লক্ষ করে,                     অন্য কোনো জন পরে,

                         যশোদ্বারে আসিবে সত্বর ।

করো না মানবগণ,                      বৃথা ক্ষয় এ জীবন,

                        সংসার-সমরাঙ্গন মাঝে;

সঙ্কল্প করেছ যাহা,                       সাধন করহ তাহা,

                       রত হয়ে নিজ নিজ কাজে ।
 

Content added || updated By

কবি পরিচিতি

406
406

 হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৩৮ সালের ১৭ই এপ্রিল হুগলি জেলার গুলিটা রাজবল্লভহাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কৈলাশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার খিদিরপুর বাংলা স্কুলে পড়াশোনাকালে আর্থিক সংকটে পড়েন। ফলে তাঁর পড়াশোনা তখন বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর কলকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীর আশ্রয়ে তিনি ইংরেজি শেখেন। পরবর্তীকালে হিন্দু কলেজে সিনিয়র স্কুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি ১৮৫৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি সরকারি চাকরি, স্কুল-শিক্ষকতা এবং পরিশেষে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত হন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের পরে কাব্য রচনায় তিনিই ছিলেন সবচেয়ে খ্যাতিমান । স্বদেশপ্রেমের অনুপ্রেরণায় তিনি বৃত্রসংহার নামক মহাকাব্য রচনা করেন। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য : চিন্তাতরঙ্গিনী, বীরবাহু, আশাকানন, ছায়াময়ী ইত্যাদি। ২৪শে মে ১৯০৩ সালে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন ।

Content added By

শব্দার্থ ও টিকা

488
488

কাতর স্বরে- দুর্বল কণ্ঠে, করুণভাবে। দারা - স্ত্রী। বাহ্যদৃশ্যে- বাইরের জগতের চাকচিক্যময় রূপে বা জিনিসে। জীবাত্মা – মানুষের আত্মা, আত্মা যদিও অমর, কিন্তু মানুষের মৃত্যু অনিবার্য, কাজেই দেহ ছেড়ে আত্মা একদিন চলে যাবে, চিরকাল দেহকে আঁকড়ে থাকতে পারবে না। অনিত্য – অস্থায়ী, যা চিরকালের নয়। আকিঞ্চন – চেষ্টা, আকাঙ্ক্ষা; আশ – আশা। ভবের -জগতের, সংসারের। সমরাঙ্গনে – যুদ্ধক্ষেত্রে (কবি মানুষের জীবনকে যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন)। বীর্যবান – শক্তিমান। মহিমা — গৌরব। প্রাতঃস্মরণীয় – সকাল বেলায় স্মরণ করার যোগ্য, অর্থাৎ সকলের শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। ধ্বজা – পতাকা, নিশান। বরণীয় – সম্মানের যোগ্য। সংসারে-সমরাঙ্গনে – যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসী সৈনিকের মতো সংসারেও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মোকাবেলা করে বেঁচে থাকতে হবে। স্বপন – রাতের স্বপ্নের মতোই মিথ্যা বা অসার। আয়ু যেন শৈবালের নীর - শেওলার ওপর পানির ফোঁটার মতো ক্ষণস্থায়ী। স্বীয় – নিজ, আপন। পদাঙ্ক – কোনো মহৎ ব্যক্তির কৃতকর্ম বা চরিত্র । যশোদ্বারে – খ্যাতির দ্বারে ।
 

Content added By

পাঠ পরিচিতি

451
451

জীবন কেবল নিছক স্বপ্ন নয়। কাজেই এ পৃথিবীকে শুধু স্বপ্ন ও মায়ার জগৎ বলা যায় না। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এবং পরিজনবর্গ কেউ কারও নয়, একথাও ঠিক নয়। মানব- জন্ম অত্যন্ত মূল্যবান। মিথ্যা সুখের কল্পনা করে দুঃখ বাড়িয়ে লাভ নেই তা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যও নয়। সংসারে বাস করতে হলে সংসারের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। কেননা বৈরাগ্যে মুক্তি নেই । আমাদের জীবন যেন শৈবালের শিশিরবিন্দুর মতো ক্ষণস্থায়ী। সুতরাং মানুষকে এ পৃথিবীতে সাহসী যোদ্ধার মতো সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হবে। মহাজ্ঞানী ও মহান ব্যক্তিদের পথ অনুসরণ করে আমাদেরও বরণীয় হতে হবে। কেননা জীবন তো একবারই। নেতিবাচকতা পরিহারপূর্বক মহামানবের পদচিহ্ন অনুসরণ করে জীবনপাঠের দীক্ষা গ্রহণের কথা কবিতাটিতে প্রকাশিত হয়েছে। 'জীবন সঙ্গীত' কবিতাটি মার্কিন কবি 'Henry Wadsworth Longfellow'- (১৮০৭-১৮৮২) এর ‘A Psalm of life' শীর্ষক ইংরেজি কবিতার ভাবানুবাদ ।

Content added By
Promotion